নোয়াখালীতে দিনব্যাপী নানা কর্মসূচির মধ্যদিয়ে বুধবার (৭ ডিসেম্বর) নোয়াখালী মুক্ত দিবস উদযাপিত হয়েছে। এ উপলক্ষে সকালে পিটিআই ইনস্টিটিউট এর সামনে মুক্ত নোয়াখালী স্মারণিক স্তম্ভে জেলা প্রশাসন, জেলা পুলিশ ও জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদসহ বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়।
এসময় মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন বৃহত্তর নোয়াখালীর বিএলএফ’র প্রধান সাবেক এমপি মাহমুদুর রহমান রহমান বেলায়েত, জেলা প্রশাসক দেওয়ান মাহবুবুর রহমান, পুলিশ সুপার মো: শহীদুল ইসলাম, স্থানীয় সরকার বিভাগের উপপরিচালক মোহাম্মদ আবু ইউসুফ, জেলা মুক্তিযুদ্ধ সংসদের সাবেক কমান্ডার মোজাম্মেল হক মিলন, বীরমুক্তিযোদ্ধা আবুল কাশেম জিএস ও মিয়া মোহাম্মদ শাহজাহান মুক্তিযোদ্ধারা উপস্থিত ছিলেন।
বিকেলে বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণে জেলা শহর মাইজদীতে বিজয় শোভাযাত্রা বের করা হয়। পরে পিটিআই ইনস্টিটিউট এর সামনে স্মৃতিচারণমূলক আলোচনা সভা আয়োজন করা হয়।

১৯৭১ এর (৭ ডিসেম্বর) এইদিনে বীর মুক্তিযোদ্ধারা চারদিক থেকে ঘিরে পাকিস্তানির হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকারের শেষ ঘাঁটি জেলা শহর মাইজদীর পিটিআই ক্যাম্পের পতন ঘটিয়ে নোয়াখালীর মাটিতে স্বাধীনতার বিজয় পতাকা উড়িয়ে নোয়াখালীকে মুক্ত করে।
যেভাবে নোয়াখালী শত্রু মুক্ত হয় :
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পর প্রায় এক মাস ধরে নোয়াখালীকে মুক্ত রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন মুক্তিকামী মানুষ ও বীর মুক্তিযোদ্ধারা। পদে পদে বাধা অতিক্রম করে পাকিস্তানি সেনারা ২৩ এপ্রিল নোয়াখালী জেলা শহরে ঢুকে পড়ে। পাকিস্তানি সেনারা কয়েক দফায় সদরের সোনাপুর, শ্রীপুর, গুপ্তাংক, রামহরিতালুক, বেগমগঞ্জের কুরীপাড়া, গোপালপুর ও আমিশাপাড়ায় নির্বিচারে গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট চালায়। এ সময় হানাদার বাহিনী গুলি করে ও পুড়িয়ে হত্যা করে প্রায় দেড় শতাধিক নারী, পুরুষ ও শিশুকে। গান পাউডার দিয়ে জ্বালিয়ে দেয় ঘরবাড়ি, দোকানপাট ও ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান।
এরপর বীর মুক্তিযোদ্ধারা দেশের অভ্যন্তরে ও ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে অস্ত্র হাতে পাকিস্তানি হানাদার ও রাজাকারদের বিরুদ্ধে মাঠে নামেন। কোম্পানীগঞ্জের বামনী, তালমাহমুদের হাট, ১২ নং স্লুইস গেট, সদরের উদয় সাধুর হাট (ওদারহাট), করমবক্স, বেগমগঞ্জের ফেনাকাটা পোল, রাজগঞ্জ ও বগাদিয়াসহ বিভিন্ন এলাকায় হানাদার বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে অংশ নিয়ে শহীদ হন অসংখ্য বীর মুক্তিযোদ্ধা।
মুক্তিযোদ্ধাদের বিজয় যখন প্রায় চূড়ান্ত, ঠিক তখনই ৬ ডিসেম্বর গভীর রাতে মাইজদী পিটিআই ও বেগমগঞ্জ টেকনিক্যাল হাইস্কুল ক্যাম্প ছেড়ে কুমিল্লা সেনানিবাসের উদ্দেশ্যে পালিয়ে যেতে থাকে পাকিস্তানি বাহিনী। এ সময় বেগমগঞ্জ-লাকসাম সড়কের বগাদিয়া ব্রিজ অতিক্রম করতেই সুবেদার লুৎফুর রহমান ও শামসুল হকের নেতৃত্বাধীন মুক্তিবাহিনীর হামলায় অসংখ্য পাকিস্তানি বাহিনী মারা যায়।
৭ ডিসেম্বর ভোর থেকে মুক্তিযোদ্ধারা নোয়াখালীকে শত্রুমুক্ত করার চূড়ান্ত অপারেশন শুরু করেন। সকাল সাড়ে ৮টার মধ্যে সব বীর মুক্তিযোদ্ধারা একযোগে চতুর্দিক থেকে আক্রমণ চালিয়ে বেগমগঞ্জ চৌরাস্তা সংলগ্ন টেকনিক্যাল হাইস্কুলে অবস্থিত রাজাকার ক্যাম্প মুক্ত করেন এবং একই দিন সকাল ৯টার মধ্যে জেলা শহর মাইজদি বাজার ভোকশনাল ইনস্টিটিউট, নাহার মঞ্জিল, রওশনবাণী সিনেমা হল, দত্তেরহাট ও সোনাপুর কোল্ডস্টেরেজের রাজাকাররা আত্মসমর্পণ করে। সকাল থেকে পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারদের প্রধান ঘাঁটি মাইজদী পিটিআই থেকে থেমে থেমে গুলিবর্ষণ করা হয়। বীর মুক্তিযোদ্ধারা পাল্টা গুলিবর্ষণ করে। শক্রপক্ষের গুলিতে শহীদ হয়েছেন নোয়াখালী কলেজের অধ্যাপক আবুল হাসেম, ছাত্র নজরুল ইসলাম স্বপন, সরকারি কর্মকর্তা আবদুল জলিল, নাজির বসু মিয়া ও একজন অজ্ঞাত আনসার সদস্য। আহত হন মুক্তিযোদ্ধা মাইন উদ্দিন জাহাঙ্গীর।
সন্ধ্যা ৫টায় চতুর্দিক থেকে ঘিরে ফেলে মাইক দিয়ে আত্মসমর্পণ করতে বলা হয়। রাজাকাররা আত্মসমর্পণ না করলে ফেনী থেকে মর্টারশেল এনে নিক্ষেপ করা হয়। প্রথম দুটি মর্টারশেল লক্ষ্যভ্রষ্ট হলেও তৃতীয়টি লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানে। মর্টারশেলের শব্দে কেঁপে উঠে পুরো শহর। বিপরীত দিক থেকে আসা গুলি বন্ধ হলে মুক্তিযোদ্ধারা ক্যাম্পে গিয়ে দেখেন, সেখানে ১০-১২ জন রাজাকারের লাশ পড়ে রয়েছে। এ সময় কয়েকজন রাজাকার বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে। এভাবে শত্রুমুক্ত হয় নোয়াখালী। বিজয়ের আনন্দে মেতে ওঠে মুক্তিকামী জনতা। শহরের কোর্ট বিল্ডিংয়ে ওড়ানো হয় পতাকা।
সেদিন মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে স্বাধীনতার বিজয় পতাকা হাতে নিয়ে হাজারো মুক্তিকামী মানুষ জয়বাংলা শ্লোগান দিয়ে বিজয় উল্লাসে জেলা শহরসহ সারা জেলাকে প্রকম্পিত করে। জেলা শহরের আগের দিন ৬ ডিসেম্বর ফেনী (মহকুমা) ও ৪ ডিসেম্বর লক্ষ্মীপুর (থানা) এলাকা শত্রুমুক্ত হয়।