“মসজিদ নির্মাণের মত পবিত্র কাজে স্বেচ্ছাশ্রম দিতে গিয়ে নির্মমভাবে খুন হয় আমার স্বামী। তখন তিন মাসের অবুঝ শিশু আমার পেটে। তার আর বাবার মুখ দেখা হলো না, জন্মের আগেই বাবাকে হারালো সে। আজ তার বয়স সাত বছর, কিন্তু কোনোদিন সে তার বাবাকে আর দেখতে পাবে না।”
কান্না জড়িত কন্ঠে এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন ২০১৬ সালের ১৪ই মার্চ নোয়াখালীর সোনাইমুড়ীতে উগ্রবাদী গোষ্ঠীর হাতে নির্মম ভাবে নিহত হওয়া ইব্রাহীম রুবেলের স্ত্রী হাজেরা আক্তার।
নোয়াখালীতে জোড়াখুনের বিচারসহ সাত দফা দাবিতে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ মিছিলে তিনি আরও বলেন, আমাদের প্রধানমন্ত্রী একজন নারী, আমি নারী হয়ে আমার স্বামীর এই হত্যাকান্ডের বিচার দাবি করছি। পিতা হারানোর কষ্ট তিনি বুঝবেন, আমার পিতৃহারা এই সন্তানের পক্ষ থেকেও দাবি জানাচ্ছি সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে অতি দ্রুত যেন এর বিচার হয়।
মঙ্গলবার (১৪ ই মার্চ) সকাল ১০টায় নোয়াখালী প্রেসক্লাবের সামনের প্রধান সড়কে এ মানববন্ধন ও বিক্ষোভ মিছিল করেছেন হেযবুত তওহীদ সংগঠনের নোয়াখালী জেলার সদস্যরা। ২০১৬ সালের ১৪ই মার্চ নোয়াখালীর সোনাইমুড়ীতে হেযবুত তওহীদ কর্তৃক নির্মাণাধীন মসজিদকে গীর্জা বলে অপপ্রচার চালিয়ে হেযবুত তওহীদের সর্বোচ্চ নেতা হোসাইন মোহাম্মদ সেলিমের বাড়িতে হামলা করা হয়। সেই হামলায় ইব্রাহিম রুবেল ও সোলাইমান খোকন নামে দু’জন হেযবুত তওহীদ কর্মীকে নৃশংস ভাবে হত্যা করা হয়। এই বিচারের দাবিতেই হেযবুত তওহীদের নোয়াখালী জেলা শাখা এই মানববন্ধন ও বিক্ষোভ মিছিল করে।
নোয়াখালী জেলা হেযবুত তওহীদের সভাপতি গোলাম কবিরের সভাপতিত্ব মানববন্ধনে বক্তব্য রাখেন হেযবুত তওহীদের কেন্দ্রীয় শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ বিষয়ক উপসম্পাদক রাকীব আল হাসান এবং হেযবুত তওহীদের চট্টগ্রাম বিভাগের সভাপতি নিজাম উদ্দিন।
২০১৬ সালের ১৪ই মার্চের হত্যাকান্ড ও ধ্বংসযজ্ঞের বিবরণ ও বর্তমান পরিস্থিতি তুলে ধরে বক্তব্য প্রদান করেন হেযবুত তওহীদের চট্টগ্রাম বিভাগীয় সভাপতি নিজাম উদ্দিন। এছাড়া হেযবুত তওহীদের আদর্শ ও বর্তমান কার্যক্রম নিয়ে বক্তব্য রাখেন সংগঠনটির কেন্দ্রীয় শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ বিভাগের উপসম্পাদক রাকীব আল হাসান।
হেযবুত তওহীদের কেন্দ্রীয় শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ বিষয়ক উপসম্পাদক রাকীব আল হাসান তার বক্তব্যে বলেন, নোয়াখালীর সোনাইমুড়ীতে যেখানে উগ্রবাদী সন্ত্রাসীরা তান্ডবলীলা চালিয়েছিল, সেই ধ্বংসস্তুপের উপরেই বর্তমানে আমরা নির্মাণ করেছি “চাষীরহাট উন্নয়ন প্রকল্প।” আমরা হতোদ্যম হইনি, নিরাশ হইনি। আমরা মনে করি আমরা যদি সত্য ও ন্যায়ের পথে অবিচল থাকতে পারি, সমাজের কল্যাণমুখী কার্যক্রম চালিয়ে যাই, তাহলে শান্তিপ্রিয় সাধারণ মানুষ যেমন আমাদের সঙ্গে থাকবেন, মহান আল্লাহ তায়ালার করুণাও আমাদের সঙ্গে থাকবে। কাজেই দেশজুড়ে হেযবুত তওহীদের সদস্যদের মালিকানাধীন ভূমি, পুঁজি ও মেধাকে একত্রিত করে আমরা বহু উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করেছি। তার মধ্যে নোয়াখালীর সোনাইমুড়ীর “চাষীরহাট উন্নয়ন প্রকল্প” অন্যতম।
তিনি আরও বলেন, হেযবুত তওহীদের এই উন্নয়ন প্রকল্পের অধীনে কৃষি, শিল্প, চিকিৎসা, শিক্ষা, বাণিজ্যসহ বহুমুখী উন্নয়ন কার্যক্রমের সমন্বয়ে নোয়াখালীর সোনাইমুড়ী উপজেলার চাষীরহাট ইউনিয়নের মানুষ আজ শান্তি ও সমৃদ্ধির বার্তা পাচ্ছে। ধর্মব্যবসায়ী উগ্রবাদী সন্ত্রাসী গোষ্ঠী ‘গির্জা’ বলে গুজব রটিয়ে যেই মসজিদটিকে গুড়িয়ে দিয়েছিল বর্তমানে সেই মসজিদটি পুন:র্নিমাণ করা হয়েছে। আমাদের সদস্যদের মাথার ঘাম পায়ে ফেলে উপার্জিত অর্থ দিয়ে, কঠোর শ্রমের বিনিময়ে তিল তিল করে গড়ে তোলা হয়েছে শহীদী জামে মসজিদ। এখন সেখানে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ, জুমার নামাজ, ঈদের নামাজ হচ্ছে। ফজরের নামাজের পর থেকেই মক্তবে চলে কোরআন শিক্ষা। রয়েছে মসজিদকেন্দ্রিক লাইব্রেরি। প্রতি জুমায় হাজারও মুসল্লির পদচারণায় মুখরিত হয় মসজিদ প্রাঙ্গণ। কাজেই আমরা আমাদের আদর্শ প্রচার করব আমাদের শান্তিপূর্ণ, উন্নয়নমূলক এই কার্যক্রম দ্বারা। আমরা হিংসার পরিবর্তে ভালোবাসা, ধ্বংসের পরিবর্তে নির্মাণের মাধ্যমেই মানুষের হৃদয় জয় করব ইনশাল্লাহ। পাশাপাশি আমরা সরকার, প্রশাসন, বিচারবিভাগের দারস্থ হব অপরাধীদের বিচারের দাবিতে এবং শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি নিয়ে মাঠে থাকব। তবে পুনরায় যদি এ ধরনের ঘটনা ঘটানোর চেষ্টা করা হয় এবং প্রশাসন যদি নীরব ভূমিকা পালন করে তবে আমাদেরও আত্মরক্ষার অধিকার আছে, ইনশাল্লাহ সেই অধিকার প্রয়োগ করব কারণ দেওয়ালে আমাদের পিঠ ঠেকে গেছে।”
হেযবুত তওহীদের চট্টগ্রাম বিভাগের সভাপতি নিজাম উদ্দিন তার বক্তব্যে ওই দিনের ঘটনা তুলে ধরে চিহ্নিত আসামীদের বিচারসহ ৭ দফা দাবি তুলে ধরেন। দাবিগুলো হচ্ছে-
১) এই ঘটনায় প্রত্যক্ষভাবে যারা জড়িত ছিল ও পরোক্ষভাবে যারা ইন্ধন যুগিয়েছিল তাদেরকে দ্রুত বিচারের আওতায় আনতে হবে।
২) চার্জশিট থেকে বাদ পড়া প্রকৃত অপরাধীদের নাম সম্পূরক অভিযোগপত্রের মাধ্যমে যুক্ত করে তাদেরকেও আইনের আওতায় আনতে হবে।
৩) পুনরায় এমন ঘটনা ঘটানোর জন্য একটা ধর্মব্যবসায়ী গোষ্ঠী মিথ্যা হ্যান্ডবিল রচনা করে ধর্মপ্রাণ জনগণকে উসকানি দিয়ে যাচ্ছে। এই মিথ্যা হ্যান্ডবিল বাজেয়াপ্ত করে এহেন অপপ্রচারের সাথে জড়িতদেরকে গ্রেফতার করে দ্রুত আইনের আওতায় আনতে হবে।
৪) সোনাইমুড়িতে বর্তমানে আমরা অন্তত ৪২ টি উন্নয়ন প্রকল্প গড়ে তুলেছি। সেই উন্নয়ন প্রকল্পের অধীনে থাকা স্থাপনাগুলো যেমন- স্কুল, মসজিদ, মক্তব, গবাদি পশুর খামার, মৎস্য খামার, বিভিন্ন ধরনের শিল্প কারখানা, কুটির শিল্প, ব্যবসা বাণিজ্য ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি সেখানে অবস্থানরত সদস্য-সদস্যাদের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
৫) সম্প্রতি চাষীরহাট ইউনিয়নের আশেপাশে পরিকল্পিতভাবে ওয়াজ-মাহফিলের নাম করে উগ্রবাদী বক্তা ভাড়া করে হেযবুত তওহীদের এমামের নাম ধরে উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়ে জনসাধারণকে পুনরায় হেযবুত তওহীদের এমামের বাড়িতে হামলা করার জন্য প্ররোচিত করা হচ্ছে। এদেরকে আইনের আওতায় আনতে হবে এবং সারা দেশে এধরনের অপতৎপরতায় যারা জড়িত তাদের প্রত্যেককে আইনের আওতায় আনতে হবে।
৬) ধর্মব্যবসা, সাম্প্রদায়িকতা, অপরাজনীতি, মাদক, হুজুগ, গুজব, জঙ্গিবাদ ইত্যাদির বিরুদ্ধে সারাদেশে হেযবুত তওহীদ যে জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করছে সেই অনুষ্ঠানগুলোর যথাযথ নিরাপত্তা প্রদান করতে হবে।
৭) ফেসবুক, ইউটিউবসহ সকল সোশ্যাল মিডিয়াতে আসল অথবা ফেক আইডি ব্যবহার করে হেযবুত তওহীদের বিরুদ্ধে ব্যাপকভাবে মিথ্যা অপপ্রচারমূলক কন্টেন্ট, হত্যার হুমকি, গুজব রটনা, মিথ্যা ফতোয়া প্রদানের মাধ্যমে যারা সন্ত্রাস সৃষ্টির পাঁয়তারা চালাচ্ছে তাদের পরিচয় ও অবস্থান চিহ্নিত করে আইসিটি আইনের আওতায় আনতে হবে।
মানববন্ধন শেষে খোকন ও রুবেলের হত্যাকারীদের বিচারের দাবিতে এবং উগ্রতা, ধর্মব্যবসা, ধর্মান্ধতা ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠিত হয়।