নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই নোয়াখালীর সোনাইমুড়ীতে চলছে ফসলি জমির মাটি কাটার মহোৎসব। প্রকাশ্য দিবালোকে অবৈধভাবে জমির মাটি কেটে বিক্রি করছে প্রভাবশালী মহল। উপজেলার প্রায় অর্ধশত জায়গা থেকে ভেকু মেশিন দিয়ে এভাবে মাটি কাটা হচ্ছে। সেগুলো বিক্রি করা হচ্ছে ইটভাটায় ও বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণে জমি ভরাটে। ফলে কমে আসছে কৃষি জমির পরিমাণ। আর প্রতিনিয়ত মাটিবোঝাই অবৈধ ট্রলি-ট্রাক চলাচল করায় নষ্ট হচ্ছে গ্রামীণ সড়ক ও মহাসড়কগুলো। সেই সাথে পরিবহণের সময় ট্রলি থেকে ছিটকে পড়া মাটি সড়কে পিষ্ট হয়ে বাড়াচ্ছে ধুলা।
সরেজমিনে দেখা যায়, আম্বরনগর, আমিশাপাড়া, চাষীরহাট, জয়াগ, দেউটি, নাটেশ্বর, নদনা, বজরা, বড়গাঁও, সোনাপুর প্রতিটি এলাকার কৃষি জমিতে চলছে মাটি খেকোদের হানা। সোনাইমুড়ী উপজেলার প্রায় প্রতিটি এলাকার চিত্র একই রকম। শতাধিক পয়েন্টে এভাবেই কেটে বিক্রি করা হচ্ছে ফসলি জমি। প্রতিদিন প্রতিটি পয়েন্ট থেকে মাটি কেটে বিক্রি করা হচ্ছে। এরমধ্যে এক ট্রাক মাটি বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৮০০ থেকে ২ হাজার টাকায়। ফসলি জমির মাটি কেটে বিক্রির এই মহোৎসবে ক্ষতির মুখে পড়েছে গ্রামীণ অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি। সেই সঙ্গে কৃষকদের মেহনতী মনোভাবেও এর প্রভাব পড়ছে।
সোনাইমুড়ীর নাওতলার গ্রামের এক কৃষক বলেন, ভবিষ্যতে তো আমাদের ফসলি জমির দরকার। মাটি কেটে কেটে খেলে, তো আর আমাদের কাজ হবে না। আমাদের ফসলের দরকার। ফসল হলে আমরা বাঁচতে পারি। এখানে একটি জমিতে ভেকু দিয়ে মাটি কেটে বিক্রি করার কারণে চারপাশের শত শত একর জমি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। চারপাশের ভূমি নষ্ট করে ফেলছে ভূমি খেকোরা।
একই এলাকার আরেক চাষি বলেন, ফসলি জমির মাটি কেটে নিয়ে যাওয়ায় আমাদের কৃষকদের চরম ক্ষতি হচ্ছে। সময়মতো ফসল উৎপাদন করতে পারছি না। আমাদের জোর দাবি কেউ যেন ফসলি জমির মাটি না কাটে।
এদিকে কুমিল্লা জেলার মনোহরগঞ্জ উপজেলার বিপুলাশার ইউনিয়নের জাওড়া গ্রাম থেকে কৃষি জমির মাঠ কেটে নিচ্ছে কিছু অবৈধ ব্যবসায়ী। আর সেই মাটি নোয়াখালী সোনাইমুড়ি উপজেলার রথী উত্তরপাড়া হয়ে যাচ্ছে ছাতাপাইয়ার বিভিন্ন ইটভাটায়।
রথী উত্তরপাড়া গ্রামের স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, সারারাত চলে মাটিবোঝাই ট্রাক ও ট্রাক্টরের তান্ডব। পাকা সড়কে মাটি পড়তে পড়তে এখন সেগুলোও কাদা-মাটির সড়কে পরিণত হয়েছে। তারপর আবার ট্রাক চলার সময়ে ধুলাবালি উড়ে চারিদিক অন্ধকার হয়ে যায়। স্থানীয় বাসিন্দারা ধুলাবালিতে প্রচণ্ড দুর্ভোগে পড়েছেন।
স্থানীয় কয়েকজন জানান, সেনবাগের ছাতারপাইয়া এলাকার একজন কন্ট্রাকটর এই মাটি কাটছেন। এখান থেকে মাটি নিয়ে দেওয়া হচ্ছে ছাতারপাইয়ার বিভিন্ন ব্রিকস ফিল্ডে। স্থানীয়রা বাধা দিলেও বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতাদের ম্যানেজ করে চলছে মাটি পরিবহন।
চাষীরহাট ইউনিয়ন পরিষদের ১নং ওয়ার্ডে জনপ্রতিনিধি মোঃ ময়নামুল হক বলেন, “হাফেজ দুলাল নামের এক ব্যক্তি এই এলাকার ওপর দিয়ে মাটি পরিবহন করছেন। তার সাথে কথা বলে গ্রামের সড়কের ক্ষতির বিষয়ে তাকে বোঝানো হয়। পরে হাফিজ দুলাল খালি গাড়ি এই গ্রামের রাস্তা ও মাটি ভরা গাড়ি বিপুলাসার রোড থেকে নেওয়ার কথা দেয়। পরবর্তীতে তারা যখন আমাদের গ্রামের রাস্তা দিয়ে লোড গাড়ি নেওয়া শুরু করে তখন গ্রামবাসী বাধা দেয়। পরে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এসে ট্রলিগাড়ি আটক করে। পরে ৬-৭ দিন ট্রলিতে মাটি পরিবহন বন্ধ ছিলো। এখন আবারও প্রতিদিন রাতে ৬-৭টি ট্রলি-ট্রাক দিয়ে সারারাত মাটি পরিবহন করছে। ফলে আমাদের এলাকার রাস্তাগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।”
নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক একই এলাকার ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক নেতা বলেন, “মনোহরগঞ্জের জাওড়া গ্রাম থেকে মাটি কেটে আমাদের বুকের ওপর থেকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এলাকাবাসী বাধা দিলে এসিল্যান্ড, টিএনও স্যারেরা এসে মাটিকাটা বন্ধ করে দেন। এখন আবার মাটি কাটা শুরু হয়েছে। তাদেরকে যখন প্রশ্ন করা হয়েছে কেন আবার মাটি কাটা হচ্ছে তখন তারা বলেছে এমপি সাহেবের অনুমতিক্রমে তারা মাটি কাটছে। এমপি সাহেব নাকি কোথায় কবরস্থান ভরাট করবে সেখান ১৫ দিন পর্যন্ত মাটি যাবে।”
উপজেলা প্রশাসন বলছে, বিভিন্ন সময় এসকল অবৈধ মাটি ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা কর হচ্ছে। বর্তমানে তারা কৌশল পাল্টে গভীর রাতে মাটি পরিবহণ করছে। এবিষয়ে উপজেলা প্রশাসন আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণে তৎপর রয়েছে।