নোয়াখালী প্রতিনিধি : নোয়াখালীর সোনাইমুড়ী উপজেলায় শ্রেষ্ঠ শিক্ষক নির্বাচনে ব্যপক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। দেশের মেধাবী শিক্ষক নির্বাচন ও পুরস্কার প্রদানে চলতি বছরে জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহ কর্মসূচি উদযাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে সরকার। আর এ কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে সোনাইমুড়ীতে শ্রেষ্ঠ প্রধান শিক্ষক ও শ্রেণী শিক্ষক নির্বাচনে অনিয়মের সত্যতা মিলেছে। আর এ কাজের সাথে জড়িত রয়েছেন খোদ সোনাইমুড়ীর উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা।
এ উপজেলা থেকে শ্রেষ্ঠ শ্রেণী শিক্ষক হিসেবে নির্বাচন করা হয়েছে আমিশাপাড়া কৃষক উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলমকে। তবে তার মূল্যায়ন শীট পর্যবেক্ষণ করে তথ্য জালিয়াতির সত্যতা মিলেছে।
মূল্যায়ন শীটে দেখা যায় ১৩টি গুনাবলীর ভিত্তিতে সর্বমোট পূর্ণমান রয়েছে ১০০। তবে নির্ধারিত নম্বরের যোগফল দেখাচ্ছে ১০৫। আর জাহাঙ্গীর আলম ১০০ নম্বরের মধ্যে পেয়েছেন ৯০।
শীটে শিক্ষাগত যোগ্যতার মাপকাঠিতে নির্ধারিত পূর্ণমান ১০ থাকলেও জালিয়াতি করে জাহাঙ্গীর আলমকে দেওয়া হয়েছে ১৪ নম্বর। এছাড়া বিতর্কিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তার অর্জিত এমএড সনদটিও স্বীকৃত নয়।
এদিকে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান গুনাবলীতে তাকে ৫ নম্বর দেওয়া হলেও তার বাবা মুক্তিযোদ্ধা নন। এক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধার সনদ যাচাইএর নির্দেশনা থাকলেও তা মানা হয়নি।
ডিজিটাল কন্টেন তৈরী ও পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন গুনাবলীতে তাকে দেওয়া হয়েছে ২০ মার্ক। তবে এ দুটি গুনাবলীর কোনটাতেই তার সম্পৃক্ততা নেই্। শিক্ষক বাতায়ণে তার নির্মিত কোন কনটেন্ট পাওয়া যায়নি।
এছাড়া শিক্ষার্থীদের সহায়তা, চারিত্রিক সুনাম এবং নিয়মানুবর্তীতা ক্যাটকরিতে তাকে পূর্ণমান ১৫ দেওয়া হয়। তবে অনুসন্ধানে যানা যায়, তার বিরুদ্ধে ২০২২ সালে স্কুলছাত্রীকে উক্তক্তের অভিযোগ ওঠে। আর এবিষয়ে ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী লিখিত অভিযোগও দিয়েছিলেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে।
শিক্ষক জাহাঙ্গীর আলমের এসকল অনিয়ম এবং জাল তথ্য অনুমোদন করে তা উপজেলা শিক্ষা অফিসারের নিকট প্রেরণ করেছেন কৃষক উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ বেল্লাল হোসেন এবং স্কুলটির ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি মো: শাহ আলম। তবে এসকল তথ্য যাচাইএর দায়িত্ব উপজেলা শিক্ষা অফিসারে হলেও তিনি তা যাচাই করেননি।
জাহাঙ্গীর আলমের সাথে যোগাযোগ করলে তিনি স্বীকার করেন তার বাবার মুক্তিযোদ্ধা সনদ নেই। এছাড়া অন্যান্য অসঙ্গতীর বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি প্রতিবেদককে কৃষক উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ বেল্লাল হোসেনের সাথে যোগাযোগ করতে বলেন।
অন্যদিকে উপজেলার শ্রেষ্ঠ প্রধান শিক্ষক হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন নিলামহাট আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোঃ জাফর উল্যা। মূল্যায়ন শীটে দেখা যায় ১৩টি গুনাবলীর ভিত্তিতে সর্বমোট পূর্ণমান রয়েছে ১০০। আর জাফর উল্যা মূল্যায়নের পূর্ণমান ১০০ এর মধ্যে পেয়েছেন ৮৭ নম্বর।
গবেষণামূলক সৃজনশীল প্রকাশনায় অংশগ্রহণে পূর্ণমান ধরা হয়েছে ১০ নম্বর। জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহ উদযাপন নীতিমালায় বলা হয়েছে শিক্ষকের ১টি গবেষণামূলক সৃজনশীল প্রকাশনা আন্তর্জাতিক খ্যাতনামা জার্নালে প্রকাশ হলে সেই শিক্ষক ১০ নম্বর পাবেন। জাতীয় জার্নালে দুটি প্রকাশনা প্রকাশ হলে প্রতিটিতে ৫ করে সর্বোচ্চ ১০ নম্বর পাবেন। আর জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশ হলে প্রতিটি পত্রিকার হিসাবে ৫ করে সর্বোচ্চ ১০ নম্বর পাবেন। তবে এই নীতিমালার বাইরে গিয়ে কোন গবেষণামূলক সৃজনশীল প্রকাশনা না করেই জাফর উল্যা পেয়েছেন ১০ নম্বর।
এছাড়া জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহ উদযাপন নীতিমালায় বলা হয়েছে এসডিজি -৪, ভিশন ২০৪১ কে সামনে রেখে লক্ষ্য নির্ধারণ, প্রতিষ্ঠানের উদ্ভাবনীমূলক উৎকর্ষ সাধন এবং ক্যাম্পাসে উত্তমচর্চা ও আর্থিক শৃঙ্খলা বিবেচনায় ভূমিকা রাখলে সেই প্রধান শিক্ষক পাবেন ১০ নম্বর। তবে এই শর্ত অনুযায়ী নিলামহাট আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক প্রতিষ্ঠানের দৃশ্যমান উদ্ভাবনীমূলক কোন উৎকর্ষ সাধন না করেই পেয়ে গেছেনে ৯ নম্বর।
জাফর উল্যার মূল্যায়ন শীট পর্যবেক্ষণ করে তাতে সাক্ষর দিয়েছেন নিলামহাট আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি হারুন-অর-রশিদ। আর এসকল জাল তথ্য তা যাচাই না করেই জেলায় পাঠিয়েছেন সোনাইমুড়ী উপজেলা শিক্ষা অফিসার।
আর এসকল অনিয়মের বিষয়ে সোনাইমুড়ী উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তাকে অবহিত করা হলেও তিনি এ বিষয়ে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি। অন্যদিকে মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার অন্যত্র বদলি হয়ে যাচ্ছেন যে কারণে যাবার আগে নিজের পছন্দের শিক্ষকদের তিনি তথ্য জাল করে শ্রেষ্ঠ পুরস্কার অর্জনের সুযোগ করে দিচ্ছেন বলেও অভিযোগ উঠছে।
আর এমন কর্মকাণ্ডে হাতাশ উপজেলার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকেরা। অনেকে এ বিষয়ে অনেকে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সোনাইমুড়ী উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো: মোস্তফা হোসেন জানান, নির্ধারিত সময় শেষ হওয়ায় এখন কিছু করার নেই। তবে তথ্য যাচাই ছাড়া কিভাবে শ্রেষ্ঠ শিক্ষক নির্বাচন করা হলো তার কোন সদুত্তর তিনি দেননি।
জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা নূর উদ্দিন মোহাম্মদ জাহাঙ্গীরের সাথে এ বিষয়ে মুঠোফোনে কথা হয় প্রতিবেদকের। তিনি জানান, জাল তথ্য দিয়ে শ্রেষ্ঠ শিক্ষক নির্বাচনের অভিযোগের বিষয়টি তিনি যাচাই করবেন। প্রমান হলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।